নানান নাটকিয়তার মধ্যে দিয়ে হয়ে গেল ২০০৭-এর কলকাতা বই মেলা। দীর্ঘ ৩৫ বছরের পর এবার হাইকোর্টের গ্রিন বেঞ্চের রায় মেনে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ময়দান থেকে শেষ মুহুর্তে যুবভারতি ক্রিরাঙ্গনে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল মেলাটাকে। তবে কোর্টের রায়টি যে অকস্মাত এসেছে তা কিন্তু নয়। গত দু বছর থেকেই উদ্যোক্তারা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন ময়দান থেকে মেলাটাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না। এবারে উদ্যোক্তাদের সাথে ছিলেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী নিজে। তাই গিল্ড ভেবেছিল এবারেও তারা পুরো জাকজমকের সাথেই বই মেলা হবে ময়দানে। কিন্তু কোর্ট তাদের আশায় জল ঢেলে দিল এবার।
কিন্তু ততদিনে অন্যান্য বছরের মতন এবারেও বিদেশি অংশগ্রহনকারিরা সব এসে হাজির।অতএব শুরু হল মাঠ খোজার জন্য হন্যে হয়ে দৌড়দৌড়ি। শেষে ৯ই ফেব্রুয়ারি নিরুপায় হয়ে যুবভারতী স্টেডিয়ামের সংলগ্ন মাঠে উদবোধন হল বই মেলা কোনরকমে। মেলা শেষ হল ২৫এ ফেব্রুয়ারি। উদ্যাপন কমিটি পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের তথ্য অনুযায়ি, আগের বছরের তুলনায় এবার ৪০% কম বই বিক্রি হয়েছে, মানুষের ভিরও হয়েছে কম। এমনটি যে হবে তা জানাই ছিল তাই কেউ আশ্চর্য হয়েছে বলে মনে হয় না। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে পরের বছর বই মেলা হবে তার আগের জাকজমক মাফিক। দেখা যাক সেই কথা থাকে কিনা।
আমি বই মেলায় গেলাম ২১এ ফেব্রুয়ারি। এবার ভেবেই রেখেছিলাম শুধু বাংলা বই কিনব। সেদিন ভাষা দিবস। ছোটো বেলায় মায়ের মুখে শুনেছি ১৯৫২র ২১এ ফেব্রুয়ারির কথা। সাথে সেই গান "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙান..." এদিনও মেলা প্রাঙ্গনে মাঝেমাঝেই বাজছিল সেই গান।
এবারের বই মেলায় কিছু জিনিষ বেশি করে নজরে পড়ল। মেলার লে-আউটের দরুণ পরিস্কার বোঝা গেল যে বেশিরভাগ মানুষই এখন বই মেলায় শুধু বেড়াতে আসেন, বই কিনতে নয়। অন্যান্য বছর ময়দানে ঘাষে বসার প্রচুর জায়গা থাকে, এবার তার অভাব কিছুটা পূরন করল স্টেডিয়ামের সিড়িঁগুলি। দেখলাম লাইন দিয়ে স্টেডিয়ামের গায়ে যেসব বইয়ের স্টল ছিল, প্রায় ফাঁকা বল্লেই হয়। তার লাগোয়া পিচের রাস্তা। তাতে উইন্ডো শপারদের ঠেলাঠেলি ভীর।
এবছর বই মেলায় গেস্ট অফ অনার ছিল অস্ট্রেলিয়া। তাদের স্টলের বাইরে অল্পবিস্তর লাইন দেখতে পেলাম।তাছাড়াও ছিল অন্যান্য বিদেশি স্টল, যেমন ফ্রান্স, আমেরিকা, ব্রিটেন, সাউথ আফ্রিকা, চিলি, ইত্যাদি। প্রায় ৩০-৪০টি দেশ এই বই মেলায় ভাগ নেয় বলেই আন্তর্জাতিক বই মেলা হিসেবে কলকাতা বই মেলার এত নাম। আমি অবশ্য এখনো মিস্ করি রাসিয়ার ভস্তক পাবলিশার্সদের যাদের কল্যানে আমরা এককালে খুব কম দামে রাসিয়ান লেখকদের বই কিনতে পারতাম। ঘুরে ঘুরে সব স্টলগুলি দেখলাম। এবার আবার একটা গেটও তৈরি করা হয়েছিল সিডনির ব্রিজের অনুকরনে। দেখে অবশ্য বোঝার জো নেই, এতই কম জায়গায় বানানো।
এরই মাঝে গেলাম বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে। সেটা তৈরি করা হয়েছিল ঢাকার বাহাদুর সাহ পার্কের গেটের আদলে। সেখানে অবশ্য ভিতরে বেশ ভীর ছিল। দেখলাম সবথেকে বেশি ডিমান্ড হুমায়ুন আহমেদের লেখার। তারই বইয়ের ছড়াছড়ি বাংলাদেশের প্রায় সব কটা স্টলে। আচ্ছা, এখানে ওপার বাংলার লেখা পড়ার এতো পাঠক, কিন্তু তবুও অন্য সময়ে কেন ওপার বাংলার বই আমরা হাতের কাছে পাই না? আমি নিজে অবশ্য এখনো খুব বেশি জানিনা ওপার বাংলার লেখকদের সম্পর্কে। যদিও ইদানিং বাংলাদেশী বন্ধুবান্ধব ও কিছু ওয়েবসআইটের দৌলতে আস্তে আস্তে জানছি। তাই
আমিও কিনে ফেললাম গোটা কতক হুমায়ুন আহমেদের সংকলন। একটা বাংলা টিভি চ্যানেল দেখলাম দুই বাংলাদেশী মহিলাকে দিয়ে ২১এ ফেব্রুয়ারির গান গাওয়াচ্ছে।
এছাড়া ছিল লিটল মাগাজিনের এক আলাদা কর্নার। আমি যখন যাই তখন প্রায় ফাঁকা। আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন একজন একাকি সৈনিক। কিন্তু এবার তারা সবাই যেন বেশ নিরুত্তাপ, অন্যান্য বছরের মতন এগিয়ে এসে পথচারিদের ধরার চেষ্টা করছিলেন না কেউই। এই বই মেলার কিছুটা গা- ছাড়া ভাব বুঝি এদেরও ছুয়ে গেছিল। কাছেই ছিল চিত্রশিল্পী গ্রাম, সেখানে আর্টিস্টরা তাদের আঁকার পসরা নিয়ে বসেছিলান। সামনে স্টেজে বাউল গান হচ্ছিল। মেলার আর এক কোনে দেখলাম এক ভদ্রলোক কাগজের কুর্তা ও টুপি পরে দাঁড়িয়ে আছেন এক গাছতলায়, ও সেই কাগজে রয়েছে তাঁর লেখা। দেখে বেশ ভাল লাগল।
আবার ২০০৮ এর প্রতিক্ষায়...আর প্রতিক্ষা করতে করতে আসুন দেশ পত্রিকার মতন আমরাও নাড়াচাড়া করি এই ভাবনাটা নিয়ে...
4 comments:
এবার দেশে গিয়েছিলাম, মানে ঢাকায়। বইমেলার আগে আগে চলে আসতে হয়েছে বলে খুব মন খারাপ ছিল।
কোলকাতা বইমেলায় যাবারও অনেক ইচ্ছে আছে, হয়ত যাব কওন একদিন।
আপনার লেখাটা ভাল লাগলো।
বাংলাদেশি লেখকদের নিয়ে কিছু আলোচনার লিংক সময় করে আপনাকে দিয়ে যাবো।
ভাল থাকবেন।
হ্যা, বইমেলার চার্মই আলাদা বলুন? বাংলাদেশি লেখকদের সম্পর্কে লিঙ্ক দিলে দারুন খুশি হব, অগ্রিম ধন্যবাদ দিয়ে রাখলাম :-)
অপর্ণা,
ধন্যবাদ আপনাকে।
এই মুহুর্তে দুটো লিম দিচ্ছি।
১। সেলিম আল দীনের গল্প পড়ার পর-
http://konfusias.blogspot.com/2007/01/blog-post_18.html
২। হুমায়ুন আজাদের- মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমুহ-
http://www.somewhereinblog.net/konfusiasblog/post/14976
বাংলাদেশের বই পশ্চিমবঙ্গে কম যাওয়ার কারণটা আসলে বই দোকানী ও আমদানীকারকদের অনিচ্ছা। বাংলাদেশের এতোগুলো ভালো ভালো বাংলা টিভি চ্যানেলকেও পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। দুই বাংলার সংস্কৃতি একই যোগসূত্রে বাঁধা, সেখানে এরকম প্রতিবন্ধকতা এসে যাওয়াটা দুঃখজনক।
Post a Comment