December 8, 2006

সালেম থেকে সিঙ্গুর - কিছু চাওয়া, কিছু ভুলে যাওয়া।

সিঙ্গুর নিয়ে আজকাল বাজার গরম। সেই নিয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে পড়ল যে এক বছর আগে এমনই এক আন্দোলন হবার কথা ছিল যখন সালেম গোষ্ঠি এই রাজ্যে জমি পেতে চলেছিল। তারপর হঠাৎই সব কেমন চুপচাপ মেরে গেল। কেন বলুন তো?

সিঙ্গুর নিয়েও কিছু পয়েন্ট আমার মনে হয় আরো পরিস্কার হওয়া দরকার। যেমন :-
  • বুদ্ধবাবু বলছেন যে মালিক জমি নিজের ইচ্ছায় বিক্রি করে দিচ্ছেন। ওদিকে মমতা বলছেন চাষিরা জমি দিতে রাজি নন। বাইরের লোক এই শুনে অবাক হয়ে ভাবতে পারেন যে তাহলে সত্যটা কি? কিন্তু লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে দুজন কিন্তু আলাদা আলাদা মানুষের কথা বলছেন। অনেক ক্ষেত্রেই জমির মালিকরা চাষ করেন না। তাদের জমিতে চাষ করেন অন্য চাষিরা এবং মালিকরা তাদের থেকে কিছু অংশ পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ চাষি এবং মালিক দুজন আলাদা ব্যক্তি, এক নন। এইবার সরকার জমি কিনছেন মালিকদের কাছ থেকে। আর মালিকরাও হয়তো এতদিন পরে তাদের বর্গাদার অধ্যুষিত জমি বিক্রি করে দিয়ে হাত পা ঝাঁড়া হতে চাইছেন। অন্যদিকে এতকাল এই চাষিরা সিপিএম থেকে শুনে এসেছে যে চাষ যার, জমি তার। এবং এই জন্য হয়তো পার্টিকে তারা এতদিন ভোটও দিয়ে এসেছে। এবার তাদের কি হবে? সিটুর ব্রিগেড সমাবেশে বুদ্ধবাবু অবশ্য জানিয়েছেন যে এখন এই বর্গাদারদেরো কিছু টাকা ইত্যাদি দেওয়া হবে। কিন্তু অনেকেই নিশ্চয় আনলিস্টেড, তাদের কি হবে? তারা তো ঠিক বুঝে উঠতে পারল না কোন অপরাধে তাদের রোজগারের পথটা বন্ধ হতে চলেছে? আর কেনোই বা সেই একই সরকার যে এতোদিন তাদের ভুমী আন্দোলনের কথা বলে এসেছে আজ অন্য সুরে গান গাইছে? তারা যে আঁদার ব্যাপারি, ইকনমি, গ্লোবালাইজেসন ইত্যাদি তাদের কাছে জাহাজের খবর বরাবর!
  • একটা লোকাল ইস্যু হঠাত গ্লোবাল হয়ে গেল। এল কংগ্রেস, এল বিজেপি, এলেন মেধা পাটেকর এবং আরো অনেকেই। বিজেপির রাজনাথ সিংহ তো সিঙ্গুরের পথে রওনাও দিলেন বিশাল কনভয় নিয়ে, এটা জানার পরেও যে সেখানে তার বিশাল দল নিয়ে যেতে পারবেন না। কিন্তু যখন দেখলেন পুলিশ তাদের চার পাচজনকে যাবার অনুমতি দিয়ে দিল, তখন তিনি ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে গায়ের জোরে 'গ্রেফতার' বরণ করলেন এবং তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফিরে এসে মমতার পাশে আশ্রয় নিলেন। পুরো নাটকটাই মিডিয়ার ক্যামেরা বন্দি হয়ে থাকল। এমনটি কেন হল? বিজেপি কি সত্যই সিঙ্গুর দরদি, না তাদের উদ্দেশ্য সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টকে একটু বিব্রত করা?
  • এই পুরো ব্যপারটায় কংগ্রেসেরি বা এখন স্ট্যান্ড কি? এক দিকে তারা তৃণমূলের ডাকা বন্ধ্‌ সাপোর্ট করল, আবার অন্য দিকে পিএম বুদ্ধবাবুর পক্ষে কথা বলছেন। তবে সিঙ্গুর নিয়ে তাদের নীতিই বা কি?
  • আমরা বলছি টাটা কেন তাদের পূর্বশুরিদের মতন দূরে কিছু অনুর্বর জমি নিয়ে তা ডেভেলপ করে তারপর শিল্প করছে না? হাইওয়ের ধারে এই জমিই কেন চাই তাদের? কিন্তু এই গলাকাটা কম্পেটিসনের যুগে মনে হয় না সেটা সম্ভব হবে, তাই না? বড়জোর তারা অন্য কোন রাজ্যে গিয়ে তাদের কারখানা করতে পারে। তাহলে কেমন হয়? মমতা আজ বলেছেন যে এরপর তিনি টাটা বয়কটের ডাক দেবেন। তার সাথে সাথে নিশ্চয় চলবে তাদের কিছু শোরুম ভাংচুর, কিন্তু তাতে লাভ কি হবে? এমনিতেই শিল্পপতিরা আমাদের রাজ্যের নাম শুনলে ঘুমের মধ্যেও আঁতকে ওঠেন, এখন তারা খানিকটা বুদ্ধবাবুর ওপর ভরসা করে উঁকিঝুঁকি মারছেন, তারা কি মানে দাঁড় করাবেন এই ঘটনার? বুদ্ধবাবু সাঁফ জানিয়ে দিয়েছেন তার এই আশঙ্কার কথা কিছুদিন আগে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে, সিটুর সমাবেশে। তবে কি আবার আমরা ভুল সিগ্‌নাল পাঠাব?
  • আর এই সব পলিটিক্স অফ অপর্চুনিস্‌মএর মাঝে সিঙ্গুরের কি হবে?

দ্য হিডেন গডের ব্লগে সিঙ্গুর ইসুতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভুমিকা নামক পোস্টটি ইন্টারেস্টিং । তার মতে, এতো সংবাদ মাধ্যম সিঙ্গুর নিয়ে লিখছে, অথচ কাউকেই নিরপেক্ষ মনে করা যাচ্ছে না। আমার মনে হয় এই ধরনের পরিস্থিতিই মনে করিয়ে দেয় যে গ্রাউন্ড রিয়ালিটি জানার পক্ষে ব্লগিং কি পরিমান কার্যকারি একটি মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। সিঙ্গুর থেকে যদি কিছু মানুষ ব্লগ করতেন তবে সেখানে ঠিক কি হচ্ছে তার কিছু ইন্ডিপেন্ডেন্ট খবরাখবর পাওয়া যেত। এটা অবশ্য ঠিক যে অনেকেই ব্লগে সিঙ্গুর নিয়ে আলোচনা করছেন কিন্তু সেগুলো বেশির ভাগই আ্যনালিসিস, কোনোটাই মনে হয় ডিরেক্ট রিপোর্টিং নয়। পশ্চিমবঙ্গে আরো, আরো অনেক ব্লগার দরকার।

4 comments:

Anonymous said...

সিঙ্গুর কাণ্ডের ফলে ভুল সিগন্যাল যাবে আর ১৪ তারিখের বনধের ফলে কি ঠিক সিগন্যাল যাবে ? এটা সিপিএমের দুমুখো নীতি । তারা যদি শিল্পায়নই চাইবে তবে কেন ১৪ তারিখের ধর্মঘট সাপোর্ট করছে ।

কংগ্রেস কখনই সিপিএম বিরোধী কোন কাজ করবে না । কারন সিপিএম সাপোর্ট তুলে নিলে তাদের সরকার পড়ে যাবে ।

সিঙ্গুর কোন লোকাল ইসু নয় । এর উপরে নির্ভর করবে ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন কেমন হবে । এই ইসুর গুরুত্ব এত বেশী যে এটা কেন্দ্রীয় সরকারের ভিতও নড়িয়ে দিতে পারে ।

টাটাদের অন্য ব্যবসা তো পশ্চিমবঙ্গে ভালোই চলছে । এতকাল তো তাদের কোন বিরোধিতা হয় নি । টাটা স্টিলের সদর দপ্তর কলকাতায় । টাটা ইন্ডিকম মোবাইল, টিসিএস, টাটা নুন, সবই তো ভাল চলছে । আজ হঠাৎ মানুষ টাটা বিরোধী হয়ে উঠল কেন ?

পৃথিবীর আর কোথায় কোথায় কৃষিজমি নষ্ট করে শিল্প তৈরি হয়েছে বুদ্ধবাবুরা তার একটা লিস্ট দিচ্ছেন না কেন ?

ছোটবেলায় ভূগোল বইতে পড়েছিলাম যে শিল্প সেখানেই গড়ে ওঠে যেখানে কাঁচামাল সহজে পাওয়া যায় ।বলুন তো গাড়ী কারখানার কাঁচামাল সিঙ্গুরের কাছাকাছি কোথায় পাওয়া যায় ? ওখানে যদি টাটারা আলুর কারখানা করত তাহলেও একটা যুক্তি ছিল ।

পরিশেষে বড় পোস্টের জন্য ধন্যবাদ

Aparna Ray said...

যে পার্টির কথাই বলুন, আইডিওলজি বলে তো বিশেষ কিছু বাকি নেই আমাদের, তাই এই অবস্থা। একই পার্টির পলিসি বিভিন্ন সময়ে, ও বিভিন্ন রাজ্যে এক এক রকম আর আইডিওলজি ওই একটাই - অপর্চুনিস্‌ম।

আর ভবিষ্যতের কথা বলছেন? এই ভাবে চললে ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গে খুব একটা বিশেষ শিল্পায়ন হবে বলে আমার মনে হয় না...আগে হয় নি আমাদের সিপিএম-এর মিলিট্যান্ট ট্রেড ইউনিয়নিস্‌ম এর জন্য, এখন কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ও পালটা পলিটিক্সের জন্য।।

এটা ঠিক যে কংগ্রেস কিছু করবে না দিল্লির গদি হারানর ভয়ে। আবার এও ঠিক যে তারি সুযোগ নিতে ও দুজনকেই কোনঠাষা করতে বিজেপি মঞ্চে এসেছে।

নানান রাজ্যে 'সেজ' জমি নিয়ে হাঙ্গামা হচ্ছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো প্যচাঁলো ঘোট কোথাও পাকাচ্ছে না, তাই না?

আর টাটা বিরোধি হওয়ার কোন যুক্তি আমি দেখছি না। তারা একটা প্রপোজাল দিয়েছিলেন মাত্র, সেটা না করে দিলেই তারা অন্য কোথাও ফ্যক্টরি করতে চলে যেতেন - না থাকত বাঁশ, না বাজতো বাঁশি!

শিল্পের জন্য কাঁচামাল লাগে এটা ঠিক, কিন্তু কাঁচামালের অঞ্চলেই শিল্প হতে হবে এই ধারনাটা মনে হয় পুরানো হয়ে গেছে। এখন পৃথিবীটা অনেক ছোট হয়ে এসেছে, এবং তাকে ছোট করার এক প্রধান উপাদান হল কমিউনিকেসন ও কানেক্টিভিটি। সিঙ্গুর একদম হাইওয়ের প্রায় ওপরে এবং এই কারনেই গাড়ির কারখানার জন্য মনোনিত হয়েছিল। গাড়ির ডেলিভারি অন্য মালের থেকে আলাদা, এগুলি দেখতে টাফ্‌ হলেও কারখানা থেকে শোরুম আনার সময় ডেলিকেট হ্যান্ডলিংএর প্রয়োজন, কোন এক দূর এলাকায়, যেখানে ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেই সেখান থেকে এগুলো সহরের শোরুমে আনা খুবই শক্ত কাজ হবে। এবরো খেবরো রাস্তায় গাড়িতে দাগ পরে গেলে আমরা কেউ কি তা কিনবো?

দূর অঞ্চলে শিল্পায়নের কাজ করার জন্য তাহলে সরকারকেই তাহোলে প্রথমে এই সব এলাকার ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল উন্নতি করতে হবে। তারপর শিল্পপতিদের আহবান করতে হবে। কারন আজকের দিনে কর্পোরেট জগতের কেউই মনে হয় এই রেস্পনসিবিলিটি নেবেন না। তাদের নানান অল্টার্নেটিভ আছে, নানান রাজ্য তাদের নানান সুযোগ সুবিধা দিতে আগ্রহি। তাই তাগিদটা তাদের থেকে আমাদেরই মনে হয় বেশি। কিন্তু এই কাজে যা সময় লাগবে (খরচের কথা তো ছেড়েই দিলাম) তা করার মতন সময়ের লাক্সারি কি আমাদের আছে? ঘুম ভাঙ্গতেই যে বড্ড দেরি হয়ে গেছে!

Arijit said...

সেইনসবুরির গপ্পোটা এখানেও লেখা উচিৎ ছিলো, হিডেন গডের ব্লগে লিখে এসেছি। আর কপি করলুম না।

Aparna Ray said...

আপনার গল্পটা ওখানে পড়েছি অরিজীত :-)
আর ঠিকই ধরেছেন, ল্যান্ডম্যাপ থাকা খুবই জরুরি। আশা করা যায় যে এবার নিশ্চই এটা বানানোর কথা ভাববেন সরকার।